তোমরা লক্ষ করলে দেখবে একটি উদ্ভিদে বহু বীজ সৃষ্টি হয়। এই বীজগুলো থেকে নতুন উদ্ভিদ উৎপন্ন হয়। এছাড়া উদ্ভিদের বিভিন্ন অঙ্গ থেকেও নতুন উদ্ভিদের সৃষ্টি হয়। এ সবই উদ্ভিদের প্রজনন বা বংশ বৃদ্ধির উদাহরণ।
এ অধ্যায় পাঠ শেষে আমরা-
• যৌন এবং অযৌন প্রজননের মধ্যে পার্থক্য করতে পারব;
• পরাগায়ন ব্যাখ্যা করতে পারব;
• বিভিন্ন প্রকার পরাগায়নের মধ্যে পার্থক্য করতে পারব,
• পরিবেশে সংঘটিত স্ব-পরাগায়ন এবং পর-পরাগায়ন চিহ্নিত করে কারণ ব্যাখ্যা করতে পারব;
• নিষিক্তকরণ প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করতে পারব;
• পরীক্ষার মাধ্যমে অঙ্কুরোদগম প্রদর্শন করতে পারব;
পৃথিবীর প্রতিটি জীব মৃত্যুর পূর্বে তার বংশধর রেখে যেতে চায়। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। যে জটিল প্রক্রিয়ায় জীব তার প্রতিরূপ বা বংশধর সৃষ্টি করে তাকে প্রজনন বা জনন বলে। প্রজনন বা জনন প্রধানত দুই প্রকার, যথা- অযৌন ও যৌন জনন।
অযৌন জনন : যে প্রক্রিয়ায় দুটি ভিন্নধর্মী জনন কোষের মিলন ছাড়াই জনন সম্পন্ন হয় তাই অযৌন জনন । নিম্নশ্রেণির জীবে অযৌন জননের প্রবণতা বেশি। অযৌন জনন প্ৰধানত দুই ধরনের, যথা- স্পোর উৎপাদন ও অঙ্গজ জনন।
(ক) স্পোর উৎপাদন : প্রধানত নিম্নশ্রেণির উদ্ভিদে স্পোর বা অণুবীজ উৎপাদনের মাধ্যমে বংশ রক্ষা করার প্রবণতা বেশি দেখা যায়। উদ্ভিদের দেহকোষ পরিবর্তিত হয়ে অণুবীজবাহী একটি অঙ্গের সৃষ্টি করে। এদের অণুবীজগুলি বলে। একটি অণুবীজথলিতে সাধারণত অসংখ্য অণুবীজ থাকে। তবে কখনো কখনো একটি থলিতে একটি অণুবীজ থাকতে পারে। অণুবীজ থলির বাইরেও উৎপন্ন হয়। এদের বহিঃঅণুবীজ বলে। বহিঃঅণুবীজের কোনো কোনোটিকে কনিডিয়াম বলে। Mucor এ থলির মধ্যে অসংখ্য অণুবীজ উৎপন্ন হয়। Penicillium কনিডিয়া সৃষ্টির মাধ্যমে বংশ বৃদ্ধি করে।
(খ) অঙ্গজ জনন : কোনো ধরনের অযৌন রেণু বা জনন কোষ সৃষ্টি না করে দেহের অংশ খণ্ডিত হয়ে বা কোনো অঙ্গ রূপান্তরিত হয়ে যে জনন ঘটে তাকে অঙ্গজ জনন বলে। এ ধরনের জনন প্রাকৃতিক নিয়মে বা স্বতঃস্ফুর্তভাবে ঘটলে তাকে প্রাকৃতিক অঙ্গজ জনন বলা হয়। যখন কৃত্রিমভাবে অঙ্গজ জনন ঘটানো হয় তখন তাকে কৃত্রিম অঙ্গজ জনন বলে।
প্রাকৃতিক অঙ্গজ জনন : বিভিন্ন পদ্ধতিতে স্বাভাবিক নিয়মেই এ ধরনের অঙ্গজ জনন দেখা যায়, যেমন -
১. দেহের খণ্ডায়ন : সাধারণত নিম্নশ্রেণির উদ্ভিদে এ ধরনের জনন দেখা যায়। Spirogyra, Mucor ইত্যাদি উদ্ভিদের দেহ কোনো কারণে খণ্ডিত হলে প্রতিটি খণ্ড একটি স্বাধীন উদ্ভিদ হিসেবে জীবনযাপন শুরু করে।
২. মূলের মাধ্যমে : কোনো কোনো উদ্ভিদের মূল থেকে নতুন উদ্ভিদের সৃষ্টি হতে দেখা যায়, যেমন— পটল, সেগুন ইত্যাদি। কোনো কোনো মূল খাদ্য সঞ্চয়ের মাধ্যমে বেশ মোটা ও রসাল হয়। এর গায়ে কুঁড়ি সৃষ্টি হয় এবং তা থেকে নতুন উদ্ভিদ গজায়, যেমন— মিষ্টি আলু।
৩. রূপান্তরিত কাণ্ডের মাধ্যমে : উদ্ভিদের কোন অংশকে কাণ্ড বলে তা নিশ্চয়ই তোমরা জানো তবে কিছু কাণ্ডের অবস্থান ও বাইরের চেহারা দেখে তাকে কাণ্ড বলে মনেই হয় না। এরা পরিবর্তিত কাণ্ড। বিভিন্ন প্রতিকূলতায়, খাদ্য সঞ্চয়ে অথবা অঙ্গজ জননের প্রয়োজনে এরা পরিবর্তিত হয়। এদের বিভিন্ন রূপ নিম্নে দেওয়া হলো :
(ক) টিউবার : কিছু কিছু উদ্ভিদে মাটির নিচের শাখার অগ্রভাগে খাদ্য সঞ্চয়ের ফলে স্ফীত হয়ে কন্দের সৃষ্টি করে, এদের টিউবার বলে। ভবিষ্যতে এ কন্দ জননের কাজ করে। কন্দের গায়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গর্ত থাকে। এগুলো দেখতে চোখের মতো তাই এদের চোখ বলা হয়। একটি চোখের মধ্যে একটি কুঁড়ি থাকে। আঁশের মতো অসবুজ পাতার (শঙ্কপত্র) কক্ষে এসব কুঁড়ি জন্মে। প্রতিটি চোখ থেকে একটি স্বাধীন উদ্ভিদের জন্ম হয়, যেমন- আলু।
কাজ : আলু ও আদা থেকে কীভাবে অঙ্গজ জনন ঘটে তা হাতেকলমে দেখাও। |
(খ) রাইজোম : এরা মাটির নিচে সমান্তরালভাবে অবস্থান করে। কাণ্ডের মতো এদের পর্ব, পর্বসন্ধি স্পষ্ট। পর্বসন্ধিতে শঙ্কপত্রের কক্ষে কাক্ষিক মুকুল জন্মে। এরাও খাদ্য সঞ্চয় করে মোটা ও রসাল হয়। অনুকূল পরিবেশে এসব মুকুল বৃদ্ধি পেয়ে আলাদা আলাদা উদ্ভিদ উৎপন্ন করে, যেমন- আদা৷
(গ) কন্দ (বাল্ব) : এরা অতি ক্ষুদ্র কাণ্ড। এদের কাক্ষিক ও শীর্ষ মুকুল নতুন উদ্ভিদের জন্ম দেয়, যেমন—পিঁয়াজ, রসুন ইত্যাদি।
(ঘ) স্টোলন : তোমরা কচুর লতি দেখে থাকবে। এগুলো কচুর শাখা কাণ্ড। এগুলো জননের জন্যই পরিবর্তিত হয়। স্টোলনের অগ্রভাগে মুকুল উৎপন্ন হয়। এভাবে স্টোলন উদ্ভিদের জননে সাহায্য করে, যেমন— কচু, পুদিনা৷
(ঙ) অফসেট : কচুরিপানা, টোপাপানা ইত্যাদি জলজ উদ্ভিদে শাখা কাণ্ড বৃদ্ধি পেয়ে একটি নতুন উদ্ভিদ উৎপন্ন করে। কিছুদিন পর মাতৃউদ্ভিদ থেকে এটি বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীন উদ্ভিদে পরিণত হয়, যেমন— কচুরিপানা।
(চ) বুলবিল : কোনো কোনো উদ্ভিদের কাক্ষিক মুকুলের বৃদ্ধি যথাযথভাবে না হয়ে একটি পিণ্ডের মতো আকার ধারণ করে। এদের বুলবিল বলে। এসব বুলবিল কিছুদিন পর গাছ থেকে খসে মাটিতে পড়ে এবং নতুন গাছের জন্ম দেয়, যেমন- চুপড়ি আলু।
৪. পাতার মাধ্যমে : কখনো কখনো পাতার কিনারায় মুকুল সৃষ্টি হয়ে নতুন উদ্ভিদ উৎপন্ন হয় । যেমন- পাথরকুচি।
এতক্ষণ যেসব প্রক্রিয়ার কথা বলা হলো তা প্রাকৃতিকভাবেই ঘটে। অঙ্গজ জননে উৎপাদিত উদ্ভিদ মাতৃউদ্ভিদের মতো গুণসম্পন্ন হয়। এর ফলে কোনো নতুন বৈশিষ্ট্যের সমাবেশ ঘটে না। উন্নত গুণসম্পন্ন অর্থকরী ফসলের ক্ষেত্রে তাই অনেক সময় কৃত্রিম অঙ্গজ জনন ঘটানো হয়।
কৃত্রিম অঙ্গজ জনন : ভালো জাতের আম, কমলা, লেবু, পেয়ারা ইত্যাদি গাছের কলম করতে তোমরা দেখেছ। কেন কলম করা হয় তা কি ভেবে দেখেছ? যেসব উদ্ভিদের বীজ থেকে উৎপাদিত উদ্ভিদের ফলন মাতৃউদ্ভিদের তুলনায় অনুন্নত ও পরিমাণে কম হয় সাধারণত সেসব উদ্ভিদে কৃত্রিম অঙ্গজ জননের মাধ্যমে মাতৃউদ্ভিদের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ করা হয়। এবার এসো কৃত্রিম অঙ্গজ জনন সম্পর্কে আমরা জানি।
১. কলম (Grafting) : কলম করার জন্য প্রথমে একটি সুস্থ গাছের কচি ও সতেজ শাখা নির্বাচন করতে হবে। উপযুক্ত স্থানে বাকল সামান্য কেটে নিতে হবে। এবার ঐ ক্ষত স্থানটি মাটি ও গোবর মিশিয়ে ভালোভাবে আবৃত করে দিতে হবে। এবার সেলোফেন টেপ অথবা পলিথিন দিয়ে ঐ স্থানটি মুড়ে দিতে হবে যাতে পানি লেগে মাটি ও গোবরের মিশ্রণ খসে না পড়ে। নিয়মিত পানি দিয়ে এ অংশটি ভিজিয়ে দিতে হবে। এভাবে কিছুদিন রেখে দিলে এ স্থানে মূল গজাবে। এর পরে মূলসহ শাখার এ অংশটি মাতৃউদ্ভিদ থেকে কেটে নিয়ে মাটিতে রোপণ করে দিলে নতুন একটি উদ্ভিদ হিসেবে বেড়ে উঠবে।
২. শাখা কলম (Cutting) : তোমরা লক্ষ করেছ যে গোলাপের ডাল কেটে ভেজা মাটিতে পুঁতে দিলে কিছুদিনের মধ্যেই তা থেকে নতুন কুঁড়ি উৎপন্ন হয়। এসব কুঁড়ি বড় হয়ে একটি নতুন গোলাপ গাছ উৎপন্ন করে।
কাজ : শাখা কলম বা কাটিং কীভাবে প্রস্তুত করতে হয় তা একটি গোলাপের ডাল দিয়ে প্রদর্শন করো। |
ফুল থেকে ফল এবং ফল থেকে বীজ হয়। বীজ থেকে নতুন গাছের জন্ম হয়। এভাবে একটি সপুষ্পক উদ্ভিদ যৌন জননের মাধ্যমে বংশ বৃদ্ধি করে। তাই ফুল উদ্ভিদের যৌন জননের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ।
ফুল : তোমার মাদরাসা বা বাড়ির আশেপাশে বহু ফুল ফুটে থাকে। এগুলো থেকে কয়েকটি এনে পর্যবেক্ষণ করে দেখ। তুমি কী সব কয়টি ফুলে মোট পাঁচটি অংশ যেমন- পুষ্পাক্ষ, বৃতি, দল বা পাপড়ি, পুংকেশর ও গর্ভকেশর দেখতে পেয়েছ? যদি পাঁচটি অংশ পেয়ে থাক তবে ফুলগুলো সম্পূর্ণ ফুল। আর যদি কোনো কোনোটিতে এই পাঁচটি অংশের মধ্যে একটি বা দুটি অংশ না থাকে তবে ফুলগুলো অসম্পূর্ণ ফুল। কখনো কখনো ফুলে এই পাঁচটি অংশ ছাড়াও বৃত্তির নিচে একটি অতিরিক্ত অংশ থাকে। একে উপবৃত্তি বলে । জবা ফুলে এমন উপবৃত্তি দেখা যায় । আবার কোনো কোনো ফুলে বৃত্ত থাকে। এগুলো সবৃন্তক ফুল এবং যে ফুলগুলোয় বৃত্ত থাকে না সেগুলো অবৃন্তক।
ফুলের বিভিন্ন অংশ
বৃত্তি : ফুলের সবচেয়ে বাইরের স্তবককে বৃত্তি বলে। সাধারণত এরা সবুজ রঙের হয়। বৃতি খণ্ডিত না হলে সেটি যুক্ত বৃতি, কিন্তু যখন এটি খণ্ডিত হয় তখন বিযুক্ত বৃতি বলে। এর প্রতি খণ্ডকে বৃত্যাংশ বলে।
বৃত্তি ফুলের অন্য অংশগুলোকে বিশেষত কুঁড়ি অবস্থায় রোদ, বৃষ্টি ও পোকা-মাকড় থেকে রক্ষা করে।
দলমণ্ডল : এটি বাইরের দিক থেকে দ্বিতীয় স্তবক। কতগুলো পাপড়ি মিলে দলমণ্ডল গঠন করে। এর প্রতিটি অংশকে পাপড়ি বা দলাংশ বলে। পাপড়িগুলো পরস্পর যুক্ত (যেমন- ধৃতরা) অথবা পৃথক (যেমন—জবা) থাকতে পারে। এরা বিভিন্ন রঙের হয়।
দলমণ্ডল রঙিন হওয়ায় পোকা-মাকড় ও পশুপাখি আকর্ষণ করে এবং পরাগায়ন নিশ্চিত করে। এরা ফুলের অন্য অংশগুলোকে রোদ, বৃষ্টি থেকে রক্ষা করে।
পুংস্তবক বা পুংকেশর : এটি ফুলের তৃতীয় স্তবক। এই স্তবকের প্রতিটি অংশকে পুংকেশর বলে। পুংকেশরের দণ্ডের মতো অংশকে পুংদণ্ড এবং শীর্ষের থলির মতো অংশকে পরাগধানী বলে। পরাগধানীর মধ্যে পরাগরেণু উৎপন্ন হয়। পরাগরেণু থেকে পুং জননকোষ উৎপন্ন হয়। এরা সরাসরি জনন কাজে অংশগ্রহণ করে।
স্ত্রীস্তবক বা গর্ভকেশর : এটি ফুলের চতুর্থ স্তবক। এক বা একাধিক গর্ভপত্র নিয়ে একটি স্ত্রীস্তবক গঠিত হয়। একের অধিক গর্ভপত্র সম্পূর্ণভাবে পরস্পরের সাথে যুক্ত থাকলে তাকে যুক্তগর্ভপত্রী, আর আলাদা থাকলে বিযুক্তগর্ভপত্রী বলে। একটি গর্ভপত্রের তিনটি অংশ, যথা- গর্ভাশয়, গর্ভদণ্ড ও গর্ভমুণ্ড। গর্ভাশয়ের ভিতরে ডিম্বক সাজানো থাকে। ডিম্বকে স্ত্রী জননকোষ বা ডিম্বাণু সৃষ্টি হয়। এরা পুংস্তবকের মতো সরাসরি জনন কাজে অংশগ্রহণ করে।
বৃতি ও দলমণ্ডলকে ফুলের সাহায্যকারী স্তবক এবং পুংস্তবক ও স্ত্রীস্তবককে অত্যাবশ্যকীয় স্তবক বলে।
পুষ্পমঞ্জরি
পুষ্পমঞ্জরি তোমরা সবাই দেখেছ। কাণ্ডের শীর্ষমুকুল বা কাক্ষিক মুকুল থেকে উৎপন্ন একটি শাখায় ফুলগুলো বিশেষ একটি নিয়মে সাজানো থাকে। ফুলসহ এই শাখাকে পুষ্পমঞ্জরি বলে। পরাগায়নের জন্য এর পুরুত্ব খুব বেশি। এ শাখার বৃদ্ধি অসীম হলে অনিয়ত পুষ্পমঞ্জরি ও বৃদ্ধি সসীম হলে তাকে নিয়ত পুষ্পমঞ্জরি বলে।
পরাগায়নকে পরাগসংযোগও বলা হয়। পরাগায়ন ফল ও বীজ উৎপাদন প্রক্রিয়ার পূর্বশর্ত। একটি ফুলের পুংস্তবকের পরাগধানীতে তোমার আঙুলের ডগা ঘষে দেখ। তোমার হাতে নিশ্চয়ই হলুদ বা কমলা রঙের গুঁড়ো লেগেছে। এই গুঁড়ো বস্তুই পরাগরেণু।
ফুলের পরাগধানী হতে পরাগরেণু একই ফুলে অথবা একই জাতের অন্য ফুলের গর্তমুণ্ডে স্থানান্তরিত হওয়াকে পরাগায়ন বলে। পরাগায়ন দু'প্রকার, যথা- স্ব-পরাগায়ন ও পর-পরাগায়ন।
স্ব-পরাগায়ন : একই ফুলে বা একই গাছের ভিন্ন দুটি ফুলের মধ্যে যখন পরাগায়ন ঘটে তখন তাকে স্ব-পরাগায়ন বলে। সরিষা, কুমড়া, ধুতুরা ইত্যাদি উদ্ভিদে স্ব-পরাগায়ন ঘটে।
পর-পরাগায়ন : একই প্রজাতির দুটি ভিন্ন উদ্ভিদের ফুলের মধ্যে যখন পরাগায়ন ঘটে তখন তাকে পর-পরাগায়ন বলে। শিমুল, পেঁপে ইত্যাদি গাছের ফুলে পর-পরাগায়ন হতে দেখা যায়।
পরাগায়নের মাধ্যম : পরাগরেণু স্থানান্তরের কাজটি অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোনো না কোনো মাধ্যমের দ্বারা হয়ে থাকে। যে বাহক পরাগরেণু বহন করে গর্তযুক্ত পর্যন্ত নিয়ে যায় তাকে পরাগায়নের মাধ্যম বলে।
বায়ু, পানি, কীট-পতঙ্গ, পাখি, বাদুড়, শামুক এমনকি মানুষ এ ধরনের মাধ্যম হিসেবে কাজ করে থাকে। মধু খেতে অথবা সুন্দর রঙের আকর্ষণে পতঙ্গ বা পাখি ফুলে ফুলে ঘুরে বেড়ায়। এ সময়ে পরাগরেণু বাহকের গায়ে লেগে যায়। এই বাহকটি যখন একই প্রজাতির অন্য ফুলে গিয়ে বসে তখন পরাগরেণু ঐ ফুলের গর্তমুণ্ডে লেগে যায়। এভাবে তাদের অজান্তে পরাগায়নের কাজটি হয়ে যায়।
পরাগায়নের মাধ্যমগুলোর সাহায্য পেতে ফুলের গঠনে কিছু পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। একে অভিযোজন বলা হয়। বিভিন্ন মাধ্যমের জন্য অভিযোজনগুলোও আলাদা। অভিযোজনগুলো নিম্নরূপ :
পতঙ্গ পরাগী ফুলের অভিযোজন : ফুল বড়, রঙিন, মধুগ্রন্থিযুক্ত। পরাগরেণু ও গর্ভমুক্ত আঠালো এবং সুগন্ধযুক্ত, যেমন— জবা, কুমড়া, সরিষা ইত্যাদি।
বায়ুপরাগী ফুলের অভিযোজন : ফুল বর্ণ, গন্ধ ও মধুগ্রন্থিহীন। পরাগরেণু হালকা, অসংখ্য ও আকারে ক্ষুদ্র। এদের গর্তযুক্ত আঠালো, শাখান্বিত, কখনো পালকের ন্যায়, যেমন— ধান।
পানিপরাগী ফুলের অভিযোজন : এরা আকারে ক্ষুদ্র, হালকা এবং অসংখ্য। এরা সহজেই পানিতে ভাসতে পারে। এসব স্কুলে সুগন্ধ নেই। স্ত্রীফুলের বৃত্ত লম্বা কিন্তু পুং ফুলের বৃত্ত ছোট। পরিণত পুং ফুল বৃত্ত থেকে খুলে পানিতে ভাসতে থাকে, যেমন— পাতাশ্যাওলা।
প্রাণিপরাগী ফুলের অভিযোজন : এসব ফুল মোটামুটি বড় ধরনের হয়। তবে ছোট হলে ফুলগুলো পুষ্পমঞ্জরিতে সজ্জিত থাকে। এদের রং আকর্ষণীয় হয়। এসব ফুলে গন্ধ থাকতে পারে বা নাও থাকতে পারে। যেমন- কদম, শিমুল, কচু ইত্যাদি।
জননকোষ (Gamete) সৃষ্টি নিষিক্তকরণের পূর্বশর্ত। একটি পুং গ্যামেট অন্য একটি স্ত্রী-গ্যামেটের সঙ্গে পরিপূর্ণভাবে মিলিত হওয়াকে নিষিক্তকরণ বলে।
পরাগায়নের ফলে পরাগরেণু গর্ভমুন্ডে স্থানান্তরিত হয়। এখান থেকে নিঃসৃত রস শুষে নিয়ে এটি ফুলে উঠে এবং এর আবরণ ভেদ করে একটি নালি বেরিয়ে আসে। এটি পরাগনালি। পরাগনালি গর্ভদন্ড ভেদ করে গর্ভাশয়ে ডিম্বকের কাছে গিয়ে পৌঁছে। ইতোমধ্যে এই পরাগনালিতে দুটি পুং গ্যামেট সৃষ্টি হয়। ডিম্বকেরভিতর পৌঁছে এ নালিকা ফেটে যায় এবং পুং গ্যামেট দুটি যুক্ত হয়। ডিম্বকের ভিতর জুবলি থাকে। এর মধ্যে ব্রী গ্যামেট বা ডিম্বাণু উৎপন্ন হয়। পুং গ্যামেটের একটি এই স্ত্রী গ্যামেটের সঙ্গে মিলিত হয়। এভাবে নিষিক্তকরণ প্রক্রিয়া শেষ হয়। অন্য গুং গ্যামেটটি গৌণ নিউক্লিয়াসের সাথে মিলিত হয় এবং সস্য উৎপন্ন করে।
ফরে উৎপত্তি : জামরা ফল বলতে সাধারণত পাম, কাঠাল, লিচু, কলা, আঙুর, আপেল, পেয়ারা, সফো ইত্যাদি সুমিষ্ট ফলগুলোকে বুঝি। এগুলো পেকে গেলে রান্না ছাড়াই খাওয়া যায়। লাউ, কুমড়া, ি পটল ইত্যাদি সবজি হিসেবে খাওয়া হলেও প্রকৃতপক্ষে এগুলো সবই ফল। নিষিক্তকরণ প্রক্রিয়া শেষ হলেই ফল গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। কিরণ গর্ভাশয়ে যে উদ্দীপনার সৃষ্টি করে তার কারণে ধীরে ধীরে গর্ভাশয়টি ফলে পরিণত হয়। এর ভিকগুলো বীজে রূপান্তরিত হয়। নিষিক্তকরণের পর গর্ভাশয় এককভাবে অথবা ফুলের অন্যান্য অংশসহ পরিপুষ্ট হরে যে জল গঠন করে তাকে ফল বলে।
শুধু গর্ভাশয় ফলে পরিণত হলে তাকে প্রকৃত ফল বলে, যেমন- আম, কাঁঠাল। গর্ভাশয় ছাড়া ফুলের অন্যান্য অংশ পুষ্ট হয়ে যখন ফলে পরিণত হয় তখন তাকে অপ্রকৃত ফল বলে, যেমন- আপেল, চালতা ইত্যাদি। প্রকৃত ও অপ্রকৃত ফলকে আবার তিন ভাগে ভাগ করা যায়, যেমন- সরল ফল, পুফল ও যৌগিক ফল।
১) সরল ফল : ফুলের একটি মাত্র গর্ভাশয় থেকে যে ফলের উৎপত্তি তাকে সরল ফল বলে, যেমন- আম। এরা রসাল বা শুষ্ক হতে পারে। সরল ফল দুই প্রকার।
রসাল ফল : যে ফলের ফলত্বক পুরু এবং রসাল তাকে রসাল ফল বলে। এ ধরনের ফল পাকলে ফলত্বক ফেটে যায় না। যেমন- আম, জাম, কলা ইত্যাদি।
নীরস ফল : যে ফলের ফলত্বক পাতলা এবং পরিপক্ক হলে ত্বক শুকিয়ে ফেটে যায় তাকে নীরস ফল বলে। যেমন-শিম, ঢেঁড়স, সরিষা ইত্যাদি।
২) গুচ্ছ ফল : একটি ফুলে যখন অনেকগুলো গর্ভাশয় থাকে এবং প্রতিটি গর্ভাশয় ফলে পরিণত হয়ে একটি বোঁটার উপর গুচ্ছাকারে থাকে তখন তাকে গুচ্ছ ফল বলে, যেমন- চম্পা, নয়নতারা, আকন্দ, আতা, শরীফা ইত্যাদি।
৩) যৌগিক ফল : একটি মজুরির সম্পূর্ণ অংশ যখন একটি ফলে পরিণত হয় তখন তাকে যৌগিক ফল বলে, যেমন- আনারস, কাঁঠাল।
কাজ : কয়েকটি ফল সংগ্রহ করো এবং এগুলো কী ধরনের ফল তা খাতার লেখ । |
বীজের গঠন : একটি বাটির মধ্যে একটি ফিল্টার পেপার রেখে পানি দিয়ে ভিজিয়ে তার উপর ৮/১০টি ভেজা ছোলার বীজ ৩/৪ দিন ঢেকে রেখে দিলে এগুলো থেকে অঙ্কুর বের হবে। বীজের সূঁচালো অংশের কাছে একটি ছিদ্র আছে, একে মাইক্রোপাইল বা ডিম্বকল্প বলে। এর ভিতর দিয়ে অণমূল বাইরে বেরিয়ে আসে। অঙ্কুর বের হওয়া বীজটিকে দুই আঙ্গুল দিয়ে সামান্য চাপ দিয়ে ছোলা বীজের আবরণটি সরিয়ে ফেললে হলুদ রঙের একটি অংশ বের হবে, এটিকে আরও একটু চাপ দিলে পুরু বীজপত্র দুটি দুই দিকে খুলে যাবে। এ দুটো যেখানে লেগে আছে সেখানে সাদা রঙের একটি লম্বাটে অঙ্গ দেখা যাবে। এর নিচের দিকের অংশকে ঘৃণমূল এবং উপরের অংশকে ভ্ৰূণকাণ্ড বলে।
ভ্রূণকাণ্ডের নিচের অংশকে বীজপত্রাধিকাণ্ড (এপিকোটাইল) ও ভ্রূণমূলের উপরের অংশকে বীজপত্রাবকাণ্ড (হাইপোকোটাইল) বলে। ভূণমূল, তৃণকাণ্ড ও বীজপত্রকে একত্রে পূর্ণ এবং বাইরের আবরণটিকে বীজত্বক বলে। বীজত্বক দু'স্তরবিশিষ্ট। বাইরের অংশকে টেস্টা এবং ভিতরের অংশকে টেগমেন বলে।
কাজ : পরীক্ষার মাধ্যমে একটি মটর বীজের বিভিন্ন অংশ প্রদর্শন করো। |
অকুরোদগম : বীজ থেকে শিশু উদ্ভিদ উৎপন্ন হওয়ার প্রক্রিয়াকে অঙ্কুরোদগম বলে। যথাযথভাবে অঙ্কুরোদগম হওয়ার জন্য পানি, ভাগ ও অক্সিজেন প্রয়োজন হয়। যখন ভূমকাণ্ড মাটি ভেদ করে উপরে উঠে আসে কিন্তু বীজপত্রটি মাটির ভিতরে থেকে যায় তখন তাকে মৃদগত অঙ্কুরোদগম বলে, যেমন ছোলা, ধান ইত্যাদি। কখনো বীজপত্রসহ স্তূপমুকুল মাটি ভেদ করে উপরে উঠে আসে তখন তাকে মৃদভেদী অঙ্কুরোদগম বলে। কুমড়া, রেড়ী, তেঁতুল ইত্যাদি বীজে মৃদভেদী অঙ্কুরোদগম দেখা যায়।
ছোলা বীজের লডুরোদগম : এক্ষেত্রে মূলগত অঙ্কুরোদগম হয়। এ প্রকার অঙ্কুরোদগমে বীজপত্র দু'টি মাটির নিচে রেখে ভূপকাণ্ড উপরে উঠে আসে। বীজ পত্রাধিকাণ্ডের অতিরিক্ত বৃদ্ধি এর কারণ। ছোলাবীজ একটি অসস্যল দ্বিবীজপত্রী বীজ। মাটিতে ছোলা বীজ বুনে পরিমিত পানি, তাপ ও বায়ুর ব্যবস্থা করলে দুই তিন দিনের মধ্যে বীজ হতে জকুর বের হবে এবং মাটির উপরে উঠে আসবে। পানি পেয়ে বীজটি প্রথমে ফুলে উঠে এবং ডিম্বকন্দ্রের ভিতর দিয়ে স্তূপমূল বেরিয়ে আসে। এটি ধীরে ধীরে প্রধান মূলে পরিণত হয়। দ্বিতীয় ধাপে ভূণকাণ্ড মাটির উপরে উঠে আসে। এক্ষেত্রে বীজপত্র দুটি মাটির নিচে থেকে যায়। প্রাথমিক অবস্থায় জুণ তার খাদ্য বীজপত্র থেকে পেয়ে থাকে।
নতুন শব্দ : অযৌন ও যৌন প্রজনন বা জনন, পরাগরেণু, টিউবার, রাইজোম, রুপ, বুলবিল, গ্যামেট, বীজপত্রাধিকান্ত, বীজগত্রাবকাণ্ড, টেলমেন, টেস্টা
এ অন্যার পাঠ শেষে যা শিখলাম-
- প্রজনন প্রধানত দুই ধরনের, যথা— অযৌন ও যৌন।
- ফুল উন্নত উদ্ভিদের জনন অঙ্গ।
- একটি আদর্শ ফুলের পাঁচটি অংশ।
- ফল প্রধানত তিন ধরনের সরল, গুচ্ছ ও যৌগিক।
- অংকুরোদগম দুই ধরনের, যথা— মূলগত ও মৃদভেদী।